মাস্ক পরুন, গরম পানির ভাপ নিন: প্রধানমন্ত্রী

789
জাতীয় সংসদের চলমান অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

রূপশ্রী প্রতিবেদন

বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) ঢাকা:

সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আবার বিশ্বব্যাপী এই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এবারের করোনাভাইরাসটি হঠাৎ করে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনটি বাংলাদেশেও। আমাদের দেশে ২৯, ৩০ ও ৩১ মার্চ এতো দ্রুত বেড়ে গেছে, যেটা চিন্তাও করা যায় না। এ জন্য জনসমাগমটা যাতে না হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। করোনাভাইরাস যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য সবাইকে মাস্ক পরার অনুরোধ জানান তিনি একইসঙ্গে বাইরে থেকে ঘরে ফিরে নাকে-মুখে গরম পানির ভাপ নেওয়ার আহবান জানান।
স্পিকার ড. শিরীন শরমিন চৈৌধুরীর সভাপতিত্বে আজ বৃস্পতিবার ১১টায় শুরু হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে আনা শোকপ্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ আহবান জানান। এ সময় সংসদ নেতা শেখ হাসিনা প্রথমবার যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন এবারও সেইভাবে নিয়ন্ত্রণ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

চলতি সংসদের সিলেট-৩ আসনের এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামসহ ৬জন সংসদ সদস্য ও বিশিষ্টজনের মৃত্যুতে আনা শোকপ্রস্তাবের ওপর আলেচনায় আরো অংশ নেন, সরকারি দলের সিনিয়র সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, মোহাম্মদ ফারুক খান, উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, নেসার আহমেদ, এনামুল হক শামীম, জাতীয় পার্টির মশিউর রহমান রাঙ্গা, পীর ফজলুর রহমান, বিএনপির হারুনুর রশীদ।

সংসদনেতার বক্তব্যের পর সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহিত হয়। পরে সবার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় এবং মরহুমদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া।
সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে মাস্ক ছিল না। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে সংসদ নেতা বলেন, আমার মাস্ক আছে মাননীয় স্পিকার। বক্তৃতা দেওয়ার জন্য খুলে রেখেছি। তাছাড়া আমার আশে পাশে এখন কেউ নেই। আমি এটা পরি। আবার কেউ যেন মনে না করেন আমি মাস্ক না পরেই (মাস্ক পরার কথা) বলছি। মাস্ক কিন্তু আমার সঙ্গেই আছে। পরেই বলি। মাস্ক পরে কথা বলতে গেলে কথাগুলো পরিষ্কার হয় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, মাস্ক পরে থাকবেন। কারণ করোনাভাইরাস নাক থেকে গিয়ে সাইনাসে আক্রমণ করে। সেই ক্ষেত্রে সবাইকে মাস্ক পরে থাকতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে নাকে ভাপ নেওয়া। ভাপ নেয়াটা খুবই কাজে লাগে। যখনই কেউ একটু বেশি মানুষের সঙ্গে মিশবেন বা দোকানপাট-অফিসে যাবেন। ঘরে ফিরে একটু যদি গরম পানির ভাপ নেন, খুব ভালো হয়। এটা খুব কঠিন কাজ নয়। একটি কাপড় দিয়ে মাথাটা ঢেকে গরম পানির ভাপটা নিঃশ্বাসে নিলে পরে নাকের ভেতরে সাইনাস পর্যন্ত চলে যায়। এসময় তিনি কাপড়ের মাস্ক পরা এবং তার যতœ নেওয়ার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কাপড়ের মাস্ক যেটা, তা সব থেকে ভালো হয়। আর মাস্কটা একবার ব্যবহার করার পর সেটা দ্বিতীয়বার না পরে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে শুকাতে দেবেন। আরেকটা পরবেন। আমরা সব সময় সেটাই করি। আমরা এ জন্য আলাদা বালতি রেখে দিয়েছি।

ভাপ নেওয়ার বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি আগে সব সময় সাইনাসে ভুগতাম। এই ভাপ নেওয়াটা আমার অভ্যাস ছিল। ভাপটা নাকের ভেতর জার্মটার যেখানে থাকার সম্ভবনা আছে, সেখানে পৌঁছাবে। সেটাকে শেষ করে দেবে বা দুর্বল করে দেবে। আরেকটা কাজ আমি নিজে করি, তা হলো কোথাও বের হওয়ার আগে নাকে একটু সরিষার তেল দেওয়া বা যেকোনও তেল দেওয়া। এটাও করতে পারেন। এটা অনেকে গ্রাম্য ব্যাপার মনে করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে আছে ছোট বেলায় যখন গোসল করতে যেতাম দাদি নাকে, কানে, নাভিতে সরিষার তেল দিয়ে দিতেন। নাকে পানি ঢুকবে না এ জন্যই। আমি মনে করি, করোনাকালে এটাও ভালো কাজ। করোনাভাইরাস আসার পর আমি নিয়মিত এটা করছি।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামল দিতে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অফিস আদালতে বলে দিয়েছি, সীমিত লোক নিয়ে কাজ করতে হবে। বেশি যেন মেশামিশি না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। অনেকেই সিমট্রম ছাড়াই করোনায় আক্রান্ত থাকতে পারেন। তার হয়তো কোনও সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু যার সঙ্গে কথা বলছেন বা মিশছেন, তার কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। এটাও মাথায় রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, করোনাভাইরাস আমরা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছিলাম। সবার মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন ঠিক হয়ে গেছে। আমরা একেবারে কমিয়েও এনেছিলাম। সব কিছু নিয়ন্ত্রণেও এনেছিলাম। অর্থনৈতিক কাজগুলোও চলছিল। কিন্তু মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছি বলে বোধ হয় মানুষের মাঝে একটি বিশ্বাস জেগে গেছে। এ জন্য সবাই ভাবছিল কিছু হয়তো হবে না। আমি বার বার বলেছিলাম ভ্যাকসিন নিলেও সাবধানে থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে। এই স্বাস্থ্যবিধি মানাটা কিন্তু বন্ধ হয়েছে। এই দাওয়াত, খাওয়া-টাওয়া, দোকান-পাটে ঘোরাঘুরি অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল। আমরা হিসাব করে দেখেছি, যতগুলো বড় বড় বিয়ের অনুষ্ঠান। যারা এই বিয়ে বাড়িতে গেছে, ফিরে এসে তাদের অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যারা কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে চলে গেছেন। সেখান থেকে যারা এসেছেন তাদের বেশি করে ধরেছে। তিনি বলেন, বিয়ে-সাদির যেগুলো তারিখ হয়েছে তা একটু ঘরোয়াভাবে করা, বেশি লোকের সঙ্গে না মেশা এবং বাইরে দোকানপাটে গেলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে আসতে হবে। জনসমাগমটা যাতে না হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রথমে করোনাভাইরাস দেখা দেওয়ার পর যেভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। আমাদের সেইভাবে আবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু নির্দেশনা আমরা দিয়েছি। ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেই ক্ষেত্রে জনগণের সহযোগিতা দরকার। করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন থাকলে এভাবে আমাদের মানুষগুলোকে হারাতে হতো না।

দেশপ্রেম কাজে লাগালে মওদুদ দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদ্যপ্রয়াত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে নিয়েও কথা বলেন। তার রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ব্যক্তিগতভাবে মওদুদ মেধাবী ছিলেন। দেশপ্রেম কাজে লাগালে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন তিনি। তবে ব্যারিস্টার মওদুদ সব সময় সরকারঘেঁষা ছিলেন। তিনি বার বার দল বদল করেছেন। তারপরও বলব তিনি মেধাবী ছিলেন। তার দেশপ্রেম কাজে লাগালে হয়তো দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি মারা যাওয়ার পর আমি নিজে হাসনার (মওদুদেও স্ত্রী) সঙ্গে কথা বলি। কারণ হাসনার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাকে আমার শোকবার্তাও জানিয়েছি।’

শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কখনও ছাত্রলীগ করেননি। তিনি সব সময় সরকার ঘেঁষাই ছিলেন। ব্যারিস্টারি পাস করে ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে আসেন। তিনি কবি জসীমউদ্দীনের মেয়ের জামাই বলে তার প্রতি একটা সহানুভূতিটা ছিল। কিন্তু তার কিছু কাজ একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। যার কারণে ’৭৩ সালে তাকে একবার গ্রেফতারও করা হয়। বাংলাদেশের কিছু গোপন তথ্য পাচার করছিলেন তিনি। জসীমউদ্দীন সাহেব নিজে এসেছিলেন আমাদের বাসায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুরোধ করলে তখন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ছিলেন-বিএনপির হারুনুর রশীদের এমন বক্তব্য ও মওদুদ আহমদের জীবনীতে লেখা ওই দাবির জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি করা হয়, তখন যে মামলা চলছিল, এখানে অবশ্য তার জীবনীতে (মওদুদ) লেখা আছে তিনি আইনজীবী ছিলেন। আসলে তিনি অ্যাপয়েনটেড আইনজীবী ছিলেন না। তিনি ড. কামাল হোসেন সাহেব এবং বঙ্গবন্ধুর পিএস মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গেই ঘুরতেন। তিনি সেই গ্রুপের সঙ্গে সব সময় ছিলেন। বিশেষ করে ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলামের সঙ্গে তার খুব ঘনিষ্টতা ছিল। দুজন সবসময় একসঙ্গেই চলতেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা আরও বলেন, আমার এখনও মনে আছে যখন আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলো এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলায় বন্দি অবস্থায় প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব হলো, তখন আমার মা এ বিষয়ে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মামলা প্রত্যাহার করে মুক্ত মানুষ হিসেবে যেন তিনি (বঙ্গবন্ধু) যান। তিনি প্যারোলে যাবেন না। তথ্যটি আমি মায়ের কাছ থেকে নিয়ে বাবাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। যেখানে বন্দি রাখা হয়েছিল সেই ক্যান্টনমেন্টে ভেতর। সেখানে তখন আমাদের অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দিন আহমেদ, তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া, আমিরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদসহ আরও নেতারা ছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং সেটাই তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন। আমি মায়ের বার্তাটা পৌঁছে দেই। অবশ্য বঙ্গবন্ধু নিজেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাকে মুক্ত মানুষ না করলে তিনি যাবেন না।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আরো বলেন, মায়ের বার্তাটা পৌঁছে বাসায় ফিরে আসার পর দোতলার বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছি। আমিরুল ইসলাম ও মওদুদ আমার কাছে আসেন। এসে আমিরুল ইসলাম সাহেব একটা কথা বলেছিলেন, আর মওদুদ তাতে সায় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে- তুমি কেমন মেয়ে! তুমি চাও না তোমার বাবা কারাগার থেকে ফিরে আসুক? জবাবে আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমার বাবা সম্মান নিয়েই ফিরে আসবেন। আপনারা এ সমস্ত বিভ্রান্তি ছড়াবেন না। এ ধরনের কিছু কিছু কাজ তার (মওদুদ) করা..। কিন্তু তিনি মুখে যাই বলুন, লেখার মধ্যে অনেক বিতর্কিত কথা তিনিমনের মাধুরি মিশিয়ে লিখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব সময় তিনি দল বদল করতে পছন্দ করতেন। যখন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ হলো, সেই ’৬৯ সালে আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন। পঁচাত্তরের পর বিএনপিতে যোগ দিলেন। তিনি সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি ছিলেন। জেনারেল এরশাদ সাহেব তাকে ক্ষমা করে দিয়ে মন্ত্রিপরিষদে আইনমন্ত্রী করলেন। আবার তিনি বিএনপিতে যোগ দিলেন। তারপরও বলবো, তিনি মেধাবী ছিলেন। তার দেশপ্রেম কাজে লাগালে হয়তো দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

রূপশ্রী/এই দেশ/আরএইচ