বাংলার নারী বাংলার মুখ

1211

মীম সাবিহা সাবরীন

 

‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ

খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে

চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে

ভোরের দোয়েল পাখি-’

কবি জীবনানন্দ দাশের চোখে দেখা এই বাংলার রূপ ছড়িয়ে আছে যেমন আমাদের প্রকৃতিতে, তেমনি ছড়িয়ে আছে বাংলার নারীর মায়াবি অবয়বে। টানা হরিণ চোখে। মধুর হাসিতে। এই হাসি মায়ের, এই হাসি কন্যার, এই হাসি প্রেমিকার। প্রতিটি হাসিতে মুগ্ধ বাঙালী জাতি। মুগ্ধ বিশ্ববাসী। বাংলার নারীর এই রূপের বাইরে আরো আছে মেধাবী, সৃজনশীল, প্রতিবাদী, পরিশ্রমী ও নির্যাতীত নারীর মুখ। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ধৈর্য্যশীল ও নিষ্ঠাবান।

জাতির অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা কাটিয়ে উঠতে এখন নারীরা লড়ছে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কৃষি থেকে কল-কারখানা, শিল্পকলা থেকে প্রযুক্তি সবখানেই নারীর সরব উপস্থিতি। আর নারীর ক্ষমতায়ন এখন বৈশ্বিক শ্লোগান। বাংলাদেশ বাংলার নারীর এই ক্ষমতায়নের কাজটা শুরু করেছিল স্বাধীনতার পর পরই। নারীর ক্ষমতায়নে জাতীয় সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত সংসদ সদস্য পদ সৃষ্টির পাশাপাশি সংবিধানে নারী শিক্ষা ও অধিকার রক্ষায় দেয়া হয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। ফলে শুরুতেই বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। এর আগে বেগম রোকেয়া ও নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী বাংলায় নারী শিক্ষার যে মশাল জ্বালিয়েছিলেন, তার আলো আজ পৌছেঁ গেছে ঘরে ঘরে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নারী শিক্ষা আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈতনিক।

রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী, আইন সভার প্রধান, বিরোধী দলের প্রধানসহ বিচারালয়ের বিচারপতি ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ সচিব হিসেবেও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। শিক্ষা প্রশাসনে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর্মি, পুলিশ, নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ডস- কোথায় নেই নারীর সফলতা? জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনেও বাঙালী নারীর সাফল্য ঈর্ষনীয়। আইন পেশায়, চিকিৎসা সেবায়, মুক্ত বুদ্ধির চর্চায়, সাংবাদিকতায় বাংলার নারীর সরব উপস্থিতি বিশ্বকে করেছে হতবাক। দেশে-বিদেশে বাংলার নারীর সুনাম ও সুখ্যাতি পড়েছে ছড়িয়ে।

এ জন্য ‘বাংলার নারী বাংলার মুখ’ শ্লোগান নিয়ে ‘রূপশ্রী ডট কম’ নামে আমাদের এই ডিজিটাল অভিযাত্রা। এতে অনেকে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। জানতে চাইছেন, দেশে এতো জাতীয় দৈনিক, সাময়িকী, নিউজ পোর্টাল থাকার পরও নতুন করে কেন রূপশ্রী টিম গঠনের প্রয়োজন হলো? সত্যিই তো, কেন?

এক সময় দেখেছি, এ দেশের জাতীয় দৈনিকগুলিতে নারীদের মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা তুলে ধরার জন্য সপ্তাহে একটি বিশেষ পাতা বের করা হতো। এখন এসব কাগজে নারীদের রূপচর্চা, ফ্যাশন, ফিটনেস, রান্না-বান্না নিয়ে ভালোই চর্চা হচ্ছে। তবে সে পাতাগুলো নেই। এতে নারীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধি বৃত্তির চর্চার জায়গায়টা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। কারণ গল্প, কবিতা, উপন্যাস, স্মৃতি কথা, ভ্রমন কাহিনী, ইতিহাস চর্চা জাতির মানস গঠন ও মানবিকতার বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রটা যেন দিন দিন উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। বাংলার অবগুন্ঠিত সময়ে সাপ্তাহিক ‘বেগম’ যে মেধাবী ও সৃজনশীল নারী সমাজ সৃষ্টি করেছিল, ইতিহাস বলে, তারাই এই দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে মুক্ত বুদ্ধি চর্চায় আমরা তাদের মুখর পদচারণা দেখি। কিন্তু তেমন একটি প্রজন্মের ধারা সৃষ্টির প্রয়াশ আর দেখিনা। আধুনকি সমাজ নারীদের বাহ্যিক রূপটা তুলে ধরার বা আন্তর্জাতিকি করণের কাজটা ভালোই করেছে। ফলে নারীদের অনেকে ‘বোহেমিয়ান’ হয়ে এখন শুধু বিদেশ যেতে চাইছে। এছাড়া কীভাবে দ্রুত অর্থ-নাম-যশ-খ্যাতি অর্জন করা যায়, তার পিছনে ছুটছে। ফলে অর্ন্তগতভাবে নারীরা আবার পিছিয়ে পড়ছে কী-না এই ভাবনা আমাদের তাড়িত করছে।

এছাড়া সমাজে নারীরা এগিয়ে যাওয়ায়, ঘরে ঘরে পদে পদে তৈরী হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতাও। মায়ের অনুপস্থিতি সন্তানকে কী কেউ কোনভাবে বিপথগামী করে তুলছে? এসব নিয়ে ভাবনার দরকার, ভাবনার জায়গাগুলো নিয়ে কাজ হওয়া দরকার। প্রতিকার দরকার। সরকার, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি অনেক সংস্থা এসব নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু সে কাজের ফলাফল কী, তা সমাজের কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে, তা তুলে ধরবে কে? জনমত গঠন করবে কে?

আজো দুর্ভাগ্যজনকভাবে আদালতের কাঠ গড়ায় নারীদের নিজেকেই প্রমাণ করতে হয় যে, সে নির্যাতিত। ভরা কোর্টে তাকে বিবরণ দিতে হয়, কে, কিভাবে, তার নারীত্বের অপমান ও নির্যাতন করেছিল। আর গণ পরিবহণে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন দখল নিয়ে তো রীতিমতো চলে বচসা। পুরুষদের কাছ থেকে শুনতে হয়, নানা কথা। অনেকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, সমান অধিকার তো পেয়েছেন, তাহলে অবলা হিসেবে আবার ‘বসার’ অধিকার চাইছেন কেন? সবাই যেভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সেভাবে আপনাদের যেতে অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা যে কোথায় তা সবাই জানে। এজন্য অনেক মেয়েকে হাতে আলপিন নিয়েই গণপরিবহণে উঠতে দেখেছি।

রূপশ্রী বের হলেই কী এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না। যাবে না। তবে লড়াইটা জারি থাকবে। বাণিজ্যিক ধারার জাতীয় দৈনিকগুলোর এসব নিয়ে মাঝে মধ্যে ভালোই কাজ করছে। তবে রাজনৈতিক খবর, অর্থনীতির খবর, দূর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন-রাহাজানির খবর দিতে দিতেই তো পত্রিকা জায়গা শেষ। শুধুমাত্র নারী নিয়ে পড়ে থাকলে তো তাদের হবে না। আদর্শবাদ, নারীবাদ করেও বাণিজ্য চলবে না। ফলে দেশের নারীবাদ, আদর্শবাদ, প্রগতিশীলতা ও মুক্তিবুদ্ধি চর্চা এখন সমাজ থেকে অনেকটাই নির্বাসিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে ব্লগে ও সামাজিক মাধ্যমে। এতে সমাজে নানা মত ও পথের বিকাশের মাত্রা যেমন বেড়েছে পাশাপাশি বেড়েছে পরনিন্দা, পরচর্চা ও গুজব সৃষ্টির উৎসব। এতে সামাজিক ঐক্যটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবার সহযোগিতায়, আমরা চেষ্টা করবো এই অবস্থাটা থেকে উত্তরণের।

আমরা সামাজিক ঐক্যটা ধরে রাখার চেষ্টা করতে চাইছি। সংবিধানে বর্ণিত নারীর অধিকার, মৌলিক অধিকার এবং সামাজিক ঐক্য যেন নষ্ট হয়ে না যায় সেসব ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কাজ করতে চাইছি। এজন্য আমরা প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোন রাজনৈতিক খবর আমরা ছাপবো না। জনগুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও নারী সংশ্লিষ্ট সব বিষয় হবে আমাদের প্রতিপাদ্য। রূপশ্রী চায় নারীদের অংশ গ্রহণে নারীদের দ্বারা নারীদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি ঐক্যবদ্ধ নারী জাগরণ ও মানবিক সমাজ নির্মাণ করতে। শুধু দরকার সবার সহযোগিতা ।

সম্পাদক ও প্রকাশক

রূপশ্রী