ঢাকা, রূপশ্রী ডেস্ক: ভারতের উত্তরপ্রদেশে ভোলেবাবা নামের এক হিন্দু সাধুর আয়োজিত ‘সৎ সঙ্গ’ ভজন অনুষ্ঠানে যোগদিতে এসে পদদলিত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন অন্তত ১১৬ জন ভক্ত। যার বেশিরভাগই নারী। নিহতদের মধ্যে কিছু শিশুও রয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। আহতদের স্থানীয় ইটাওয়া হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) উত্তরপ্রদেশে হাথরাস জেলার সিকান্দ্রা রাও এলাকার রাতি ভানপুর গ্রামে ‘মানব মঙ্গল মিলন সদ্ভাবনা’ শীর্ষক ভক্ত মেলায় এই প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। ভারতের লোকসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় বিষয়টি জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সাথে সাথে বক্তৃতা থামিয়ে তিনি শোকপ্রকাশ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর নিহতদের জন্য ২ লাখ রুপি হারে ও আহতদের ৫০ হাজার রুপি হারে ক্ষতিপূর্ণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

হাথরসের মর্মান্তিক প্রাণহানীর ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, পশ্চিমবঙ্গের মু্খ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এছাড়া উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই আগ্রার অতিরিক্ত ডিজিকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনার খবর পেয়ে মুঘলাগড়ি গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী এবং সন্দীপ সিংহ। রাজ্য পুলিশের ডিজিও ঘটনাস্থলে গিয়েছেন।
আনন্দবাজার পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, উত্তরপ্রদেশের হাথরসে সিকান্দরারাউ এলাকায় ‘সৎসঙ্গ’ অনুষ্ঠানে পদপিষ্ট হয়ে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আলিগড়ের কমিশনার নিশ্চিত করেছেন, এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে প্রশাসনিক ভূমিকা নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে বিপর্যয়ের কারণ নিয়েও। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় সৎসঙ্গের আয়োজক কমিটিকেই দায়ী করছেন অনেকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, সৎসঙ্গের জন্য যে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছিল, তা ঘেরা ছিল। পাখার ব্যবস্থা করা হয়নি। প্যান্ডেল খোলামেলা থাকলেও আর্দ্রতা এবং গরমের কারণে সকলেই হাঁসফাঁস করছিলেন। ফলে সৎসঙ্গ শেষ হওয়ার পরেই মানুষ হুড়মুড়িয়ে মাঠের বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আসা-যাওয়ার জন্য যে গেট তৈরি হয়েছিল, সেটিও অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হওয়ার কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অনেকে মাটিতে পড়ে যান। বাকিরা তাঁদের উপর দিয়েই বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করেন।
স্থানীয় সূত্রে খবর, নারায়ণ সাকার ওরফে ‘ভোলে বাবা’ নামে স্বঘোষিত এক ধর্মীয় গুরুর জন্য ‘মানব মঙ্গল মিলন সদ্ভাবনা অনুষ্ঠান কমিটি’র তরফে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত ওই সৎসঙ্গের আয়োজন করা হয়েছিল মঙ্গলবার। অংশগ্রহণ করেছিলেন হাজার হাজার ভক্ত। ভক্তদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মহিলা। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওই সৎসঙ্গে যোগ দিতে এসেছিলেন তাঁরা। সেখানেই ঘটে যায় বিপর্যয়।

অপর সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, যেখানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল সেখানকার আবহাওয়া প্রচণ্ড গরম ও আদ্র ছিল। এরমধ্যে অস্থায়ী তাঁবু গেড়ে সেখানে অনুষ্ঠানটি করা হয়েছিল। ওই তাঁবুর ভেতর থাকা মানুষ একটা সময় দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে পড়েন। এরপর অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর দ্রুত বের হয়ে গেলে অনেকে পদদলিত হয়ে নিহত হন।
সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৎসঙ্গে গিয়ে আহত এক ব্যক্তি বলেন, “ঘটনাস্থলে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়েছিল। ফলে প্রচণ্ড ভিড়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। বাইরে যাওয়ার কোনও চওড়া রাস্তা ছিল না। সৎসঙ্গ শেষে সকলেই একসঙ্গে বেরোনোর চেষ্টা করলে এই ঘটনা ঘটে। অনেকে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান। অনেকে অজ্ঞান হয়ে যান। আমিও বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলের বাইরেই অনেক মোটরবাইক দাঁড় করানো ছিল। যার জন্য আমি বেরোতে পারিনি।’’
আর এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, ‘‘হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম হয়েছিল। তবে প্যান্ডেলের মধ্যে কিছু হয়নি। রাস্তায় যে মেন গেট তৈরি হয়েছিল, সেখান দিয়ে বেরোনোর সময় অনেকে রাস্তার ডান দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন, আর অনেকে বাঁ দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সময়ই ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। যাঁরা মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের উপর দিয়েই অনেকে চলে যান।’’

ওই অনুষ্ঠানে যে অতিরিক্ত ভিড় হয়েছিল, তা মেনে নিয়েছেন হাথরসের জেলাশাসক আশিস কুমার। তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে অত্যধিক হুড়োহুড়ির জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসনের তরফে পদক্ষেপ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
মঙ্গলবার লোকসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন মোদী। সংসদে ভাষণ দেওয়ার সময় বিষয়টি জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তার পরেই তিনি বক্তৃতা থামিয়ে শোকপ্রকাশ করেন। একইসঙ্গে সব রকমের সাহায্যের আশ্বাস দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জানান, রাজ্য সরকার উদ্ধারকাজ করছে।
তার পরেই এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে ওই ঘটনায় ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর।প্রধানমন্ত্রীর দফতর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছে, ‘‘হাথরসের ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’’ এর পরে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল থেকে এই টাকা দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু শোক প্রকাশ করে এক্সে লিখেছেন, ‘‘হাথরসে মহিলা এবং শিশু-সহ বহু মানুষের মৃত্যুর খবর দুঃখজনক। যাঁরা নিজের পরিজনকে হারিয়েছেন, তাঁদের সমবেদনা জানাই। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।’’
কে এই ভোলেবাবা
প্রাণ হারানো এসব মানুষ গিয়েছিলেন ভোলে বাবা নামক এক কথিত ধর্মগুরুর অনুষ্ঠানে। এই ভোলে বাবা নারায়ণ সরকার হরি নামে পরিচিত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, ভোলে বাবা প্রায়ই তার ভক্তদের কাছে দাবি করে থাকেন তিনি গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেছেন। তিনি ভক্তদের আরও বলে থাকেন, গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সময়ই আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং ১৯৯০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, ভোলে বাবা উত্তরপ্রদেশের ইতাহ বিভাগের বাহাদুর নগরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি দাবি করেন, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ শুরু করেন।
ভোলে বাবার অন্যতম একটি আলাদা দিক হলো তিনি ভারতের অন্যান্য ধর্মগুরুর মতো জাফরান রঙের পোশাক পরেন না। এর বদলে সাদা স্যুট এবং টাই পরেন। এছাড়া তার পছন্দের তালিকায় রয়েছে কুর্তা-পায়জামা।
ভক্তদের কাছে কথিত এই ধর্মগুরু বলে থাকেন, তারা তাকে যেসব অর্থ দেয় তার কিছুই নিজের জন্য রাখেন না। এরবদলে ভক্তদের পেছনেই সব অর্থ ব্যয় করেন।
নারায়ণ হরি নিজেকে হরির শিষ্য হিসেবে অভিহিত করেন এবং উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে তার বেশ ভালো পরিমাণ ভক্ত রয়েছে।
দেশটির সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস বলেছে, হাথরাস জেলার সিকান্দ্রা রাও এলাকার রাতি ভানপুর গ্রামে বিশেষ তাঁবু টানিয়ে সৎসঙ্গ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ধর্মীয় এক প্রচারক অনুসারীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
উত্তরপ্রদেশের আলীগড় রেঞ্জ পুলিশের মহাপরিদর্শক শালভ মাথুর বলেন, হাথরাসের রাতি ভানপুর গ্রামে ধর্মীয় প্রচারক ভোলে বাবার সৎসঙ্গ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। মঙ্গলবার দুপুরের দিকে ইতাহ ও হাথরাস জেলার সীমান্তের ওই অনুষ্ঠানস্থলে জড়ো হওয়ার জন্য ভক্তদের সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।