নবী নন্দিনী মা ফাতিমা (রা.) শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন কেন?

ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ নারীরা-দুই

1444

ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ নারীরা-দুই

মীম সাবিহা সাবরীন

পর্ব-এক
দুনিয়া ও আখিরাতের শ্রেষ্ঠ মানব আল্লাহর প্রিয় হাবিব, নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ছিলো চার কন্যা। হজরত জয়নব (রা.), হজরত রুকাইয়াহ (রা.) হজরত উম্মে কুলসুম (রা.) ও হজরত ফাতিমা (রা.)। এরমধ্যে শুধু মা ফাতিমা রাজিআল্লাহু আনহা দুনিয়া ও আখিরাতে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান চার নারীর অন্যতম হওয়ার গৌরব লাভ করেছিলেন। তাঁরা কারা? নবীজীর হাদিস অনুযায়ী চারজন নারী সমগ্র নারী জাতির মধ্যে সর্বোত্তম। এক মারইয়াম বিনতে ইমরান (আ.), আছিয়া বিনতে মুযাহিম (আ.),খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.) এবং ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ (সা.)। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন মা ফাতিমা (রা.)।
পিতার ইন্তেকালের পর যিনি লিখেছিলেন,

“আকাশের দিগন্ত ধুলিমলিন হয়ে গেছে,
মধ্যাহ্ন-সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে এবং যুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে।
নবীর পরে ভূমি কেবল বিষন্ন হয়নি, বরং দুঃখের তীব্রতায় বিদীর্ণ হয়ে গেছে।
তাঁর জন্য কাঁদছে পূর্ব-পশ্চিম, মাতম করছে সমগ্র মুদার ও ইয়ামান গোত্র।
তাঁর জন্য কাঁদছে বড় বড় পাহাড়-পর্বত ও বিশালকায় অট্টালিকাসমূহ্
হে খাতামুন নাবিয়্যীন,
আল্লাহর জ্যোতি আপনার প্রতি বর্ষিত হোক।
আল-কুরআনের নাজিলকারী আপনার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন।”

নবী দুহিতা হিসেবে মা ফাতিমা নবীজীর কাছ থেকে দুনিয়ায় উত্তরাধিকার হিসেবে ঘর-বাড়ি, ধন-দৌলত, দাসি-বাদি কিছুই পাননি। নবীজী মা ফাতিমাকে ফাদাক নামক একটি খেজুর বাগান উপহার দিয়েছিলেন। তবে নবীজীর ওফাতের পর সেই খেজুর বাগান খিলাফতের মালিকানায় নিয়ে নেয়া হয়। এতে তিনি দু:খ পেয়েছিলেন পিতার দেয়া দান ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। এ বিষয়ে প্রতিবাদও করেছিলেন। কিন্তু যখন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ‘আল্লাহর নবীরা যা রেখে যায়, তা সদকা হয়ে যায়’ অর্থাৎ উত্তরাধিকার হয় না বলে নবীজীর হাদিসের উল্লেখ করেন, তখন নিরবেই ঘরে ফিরে আসেন মা ফাতিমা।

তিনি ছিলেন ধনীর দুলারী। আরবের শ্রেষ্ঠধনী মা খাদিজার (রা.) আদরের সন্তান। যিনি প্রথম মুসলমান, যিনি তার সকল ধন-সম্পদ ব্যয় করে দিয়েছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। যার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি আখিরাতে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান নারীদেরও অন্যতম। এমন একজন ধনী ও ক্ষমতাবান মায়ের মেয়ে হয়েও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি দুনিয়ার সম্পদ, সুখ, বিলাসিতা ত্যাগ করেছিলেন হাসি মুখে। আদরের ছোট মেয়ে হিসেবে কোন কিছু পাওয়ার জন্য তিনি কখনো জেদ করতেন না। ছোটকালে তো না-ই, প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়েও না।
মা ফাতেমাকে বিয়ে করতে উম্মুখ ছিলেন আরবের ধনী ও বীর পুরুষেরা। এমনকি মা ফাতেমাকে বিয়ে করতে নবীজীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন হযরত ওমর (রা.) এবং হযরত ওসমান (রা.) পর্যন্ত। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর রাসূল মা ফাতেমাকে তুলে দেন আরবের শ্রেষ্ঠবীর কিন্তু দুনিয়ার লোভ-লালসাহীন ও সম্পদহীন আল্লাহর প্রিয়পাত্র হজরত আলী (রা.)- এর হাতে। ধনীদের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে নবীজী যখন দুনিয়ার গরীব আলী (রা.) সাথে বিয়ের প্রস্তাব করেন, মা ফাতিমা দ্বিরুক্তি করেননি। সন্তুষ্ট চিত্তেই সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন মা ফাতেমা।
বিয়ের পরে দু’বার স্বামীর (আলী রা.) পরামর্শে পিতার কাছে গিয়েছিলেন দুনিয়ার অভাব মিটানোর দাবি নিয়ে। প্রথমবার পিতার সামনে গিয়ে লজ্জায় বলতেই পারেননি কিছু। ফিরে এসেছেন খালি হাতে। দ্বিতীয়বার গিয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, ফিরিশতাদের খাদ্য হলো তাসবিহ-তাহলিল-তাহমিদ। কিন্তু আমাদের খাবার কী?’। জবাবে আল্লাহর রাসূল মেয়েকে বলেন, ‘আমার নিকট কিছু ছাগল এসেছে। তুমি চাইলে পাঁচটি ছাগল তোমাকে দিতে পারি। আর তুমি যদি চাও এর পরিবর্তে আমি তোমাকে পাঁচটি কথা শিখিয়ে দিতে পারি, যা জিবরীল (আ.) আমাকে শিখিয়েছেন।’ মা ফাতিমা বললেন, ‘সেই পাঁচটি কথাই আমাকে শিখিয়ে দিন।’ তিনি যখন খালি হাতে বাড়ি ফিরলেন, আলী (রা.) জানতে চাইলেন, খবর কী? তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম, আখিরাত নিয়ে ফিরে এসেছি।’

বাল্যকাল থেকে বিয়ের আগে পর্যন্ত তিনি নবীজীর পাশে থেকেছেন ছায়ার মতোন। ফলে তাঁর মধ্যে দুনিয়াবী লোভ, লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ দানা বাধতে পারেনি। তিনি ছিলেন এসব থেকে পবিত্র। তাই দুনিয়াবী কোন শান-শওকত অর্জন ও প্রদর্শনের আকাঙ্খা থেকেও তিনি ছিলেন পবিত্র। অথচ তাঁর শৈশব কেটেছে দাসী-বাদি পরিবেষ্টিত আরবের অভিজাত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে। কিন্তু মায়ের দীক্ষা, শিয়ারে আবু তালিবের অবরোধকালীন জীবন, নবীজীর শিক্ষা ও ইসলামের আদর্শ তাঁকে পরিণত করেছিলো এক আদর্শ ধর্ম-ভীরু মু’মিন নারীতে। তাই বিয়ের পর আমরা মা ফাতিমাকে দেখি চরম ধৈর্য্যশীলা ও কঠোর পরিশ্রমী এক নারী হিসেবে। দেখি, পরিবারের সদস্যদের জন্য কূয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে আনতে, যাঁতায় যব পিশে তা দিয়ে রুটি বানাতে, রান্না করতে, শাশুড়ীর খেদমত করতে, সন্তান লালন পালন করতে। আবার দেখি তিনি যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধাদের পানি খাওয়াচ্ছেন, আহতদের সেবা-শ্রুশ্রষা করছেন। আবার দেখি, যখন পারিবারিক দাসী পেলেন, তখন দাসীর সাথে ভাগাভাগী করে কাজ করতে। আবার তাদের আজাদ করে দিয়ে তিনি পেতেন অপার আনন্দ। এভাবেই ঈমানে, আমলে, আখলাকে এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় তিনি ধীরে ধীরে নারী সমাজের পথ প্রদর্শক হয়ে ওঠেন। দুনিয়ায় থেকেই স্বীকৃতি পান আখেরাতে শ্রেষ্ঠ নারীদের অন্তুর্ভুক্ত হওয়ার। তাঁর জীবন গবেষণা করে দেখা যায়, এই স্বীকৃতির প্রধান কারণ মা ফাতিমা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের অসন্তুষ্টি ভয় পেতেন এবং পবিত্র কোরআনের ঘোষণা ‘আতিউল্লাহা ওয়া আতিউর রাসূল’ বা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য অর্জনের জন্য ছিলেন নিবেদিত প্রাণ এবং পূণ্যবতী নারী।

ফাতিমা ছিলেন একান্ত লাজুক ও পর্দানসীন নারী। আলী (রা.) একবার এক অন্ধ ব্যক্তিকে ঘরের অভ্যন্তরে ডাকলেন। মা ফাতিমা দ্রুত পাশের ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন। পরে এ বিষয়ে আলী রা. জানতে চাইলে, বলেছিলেন, সে অন্ধ, আমি নই। তাছাড়া সে আমার শরীরের গন্ধ পেতো, তার নাক বন্ধ নয়। সে আমার কন্ঠস্বর শুনতে পেতো কারণ সে বধির নয়। মা ফাতিমা ছিলেন, এমনই সচেতন, মিতবাক, সংযমী নারী।
মা ফাতিমার সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, কাবাঘরের সামনে সেজদারত অবস্থায় নবীজীর পিঠে যখন ইসলামের শক্ররা পশুর নাড়ি-ভূড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল, তখন খবর পেয়ে মা ফাতিমা ছুটে এসেছিলেন এবং ওসব সরিয়ে পানি দিয়ে ধূয়ে নবীজীকে পরিচ্ছন্ন করেছিলেন। এসময় এই অপকর্মের হোতারা যখন দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা ও বিদ্রুপ করে হাসছিলো, সাহসী মা ফাতিমা তাদের দিকে এগিয়ে যান এবং তাদের অপকর্মের জন্য ভর্ৎসনা করেন।

দুনিয়া ও আখিরাতে মহিয়ষী নারী হজরত মা ফাতিমা (রা.) জীবনী আলোচনা করতে যেয়ে আমরা প্রথমেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ নিয়ে নানা মতভেদ। মৃত্যুর তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও তা মোটামুটি কাছাকাছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের ওফাতের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে। নবী পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে এই মতভেদ খুবই কম। কিন্তু জন্ম সাল ও তারিখ নিয়ে দশ বছরের ব্যবধান ও অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। আমার এখানে মা ফাতিমার জীবনে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তাঁর পিতা-মাতার জীবনে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে চেষ্টা করবো সত্যের কাছাকাছি যাওয়ার।

চলবে…